আপডেট:
18 November 2024

বিসিএস সম্পর্কে প্রচলিত ১০টি ভুল ধারণা ও বিস্তারিত বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক এবং সম্মানজনক পরীক্ষাগুলোর মধ্যে বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) অন্যতম।

প্রতিবছর লাখ লাখ তরুণ-তরুণী বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, যা একটি কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, যেখানে সফল হতে চাইলে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি ও সঠিক গাইডলাইন থাকা প্রয়োজন।

তবে, বিসিএস নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে যা অনেক পরীক্ষার্থীকে বিভ্রান্ত করে। আসুন, এসব ভুল ধারণা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানি।

 

১. শুধুমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বিসিএসে সফল হতে পারে

এটি একটি সাধারণ ভুল ধারণা, বিশেষত মফস্বল বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তারা মনে করেন, শুধুমাত্র ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিসিএসে সফল হতে পারে।

তবে বাস্তবতা হলো, আপনার কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কোনটা, কিংবা আপনার রেজাল্ট কেমন এসব কিছুই বিসিএস পরীক্ষায় সফলতার সাথে সম্পর্কিত নয়।

বিসিএসের সফলতা নির্ভর করে আপনার প্রস্তুতি, নিজের কষ্ট এবং আত্মবিশ্বাসের ওপর। যে কোনো শিক্ষার্থী, যে যতটা পরিশ্রম করবে এবং যতটা যোগ্যতা অর্জন করবে, সে বিসিএস পরীক্ষায় সফল হতে পারবে।

 

২. বিসিএসের প্রস্তুতি মানেই একাডেমিক পড়াকে দূরে রাখা

অনেকে ভাবেন, বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করলে একাডেমিক পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু এটা ধারণা ভুল। বিসিএসের প্রস্তুতি একাডেমিক পড়াশোনার সাথে সমন্বয় করেই নিতে হবে।

একাডেমিক পড়াশোনা না করলে বিসিএসের প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেওয়া ঠিক নয়। একাডেমিক বিষয়ের ওপর আপনার জ্ঞান যদি ভালো থাকে, তবে বিসিএস প্রস্তুতিও সহজ হয়ে যাবে।

কিছু নির্দিষ্ট ক্যাডার (যেমন: প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র) নির্বাচিত হলে সেই বিষয়বস্তুর উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়। তাই, একাডেমিক পড়াশোনা গুরুত্ব সহকারে নিলেই ক্যাডার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

 

৩. প্রথম বিসিএসেই ভালো ক্যাডার পাওয়া যায় না

অনেকেই মনে করেন যে, জীবনের প্রথম বিসিএসে তারা ভালো ক্যাডার পাবেন না। তবে বাস্তবতা হলো, যদি আপনি প্রথম বিসিএসে ভালো প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন, তবে আপনি সাফল্য পেতে পারেন।

অনেক সেরা ক্যাডার প্রথম বিসিএসে সফল হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, ৩৭তম বিসিএসের প্রথম র‍্যাংকধারী, হালিমুল হারুন (পুলিশ ক্যাডার) এবং ত্বকী ফয়সাল (প্রশাসন ক্যাডার) -এই দুজনেরই প্রথম বিসিএসে সফলতা ছিল।

তাই, প্রস্তুতি যত ভালো হবে, ততই ভালো ফলাফল আসবে, এবং প্রথম বিসিএসেই সফল হওয়া সম্ভব।

 

৪.  দুর্নীতি/ঘুষ ব্যতিত বিসিএস ক্যাডার হওয়া যায় না

এই ধারণাটি একেবারেই ভুল। অনেকে বলেন, বিসিএস ক্যাডার হতে হলে কোনো না কোনো অনৈতিক উপায় অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

বিসিএসে সফলতা আসে আপনার সঠিক প্রস্তুতি, পরিশ্রম, এবং দক্ষতার মাধ্যমে। আপনাকে যদি কেউ বলে যে টাকার বিনিময়ে ক্যাডার পাওয়া সম্ভব, তবে তাকে এড়িয়ে চলুন।

বিসিএস পরীক্ষায় সঠিক উপায়ে ভালো ফলাফল অর্জন করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

 

৫. বিসিএস একটি মুখস্থ নির্ভর সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা মাত্র

অনেকের ধারণা থাকে যে বিসিএস শুধুমাত্র মুখস্থ করা সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষার মতো। কিন্তু এটি স্পষ্টত একটি ভুল ধারণা।

বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণ জ্ঞানের পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, মানসিক দক্ষতা, কম্পিউটার জ্ঞান এবং আরও অনেক কিছু পরীক্ষা করা হয়।

বিসিএস পরীক্ষার সিলেবাসটি অনেক ব্যাপক এবং একটি ভালো প্রস্তুতির জন্য কেবল মুখস্থ করলেই চলবে না, আপনার সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং মেধার পরিচয় দিতে হবে, বিশেষত ভাইভা পরীক্ষায়।

শুধু মুখস্থ করা কিংবা তোতাপাখির মতো কথা বলেই ক্যাডার হওয়া যায় না। ভাইভা পরীক্ষায় অবশ্যই আপনাকে মেধার পরিচয় দিতে হবে।

 

৬. পরীক্ষার আগে কয়েক মাস পড়লেই ক্যাডার হওয়া যায়

এটা এমন একটি ধারণা যা সাধারণত ছাত্রজীবনে যারা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন না, তারা মনে করেন।

বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর কয়েক মাসের প্রস্তুতিতেই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব।

কিন্তু বাস্তবতা একদম ভিন্ন। বিসিএসের প্রস্তুতি একদিনের বা এক মাসের কাজ নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া।

ছাত্রজীবনের প্রথম থেকেই ভালো প্রস্তুতি নিতে হবে, যেমন পত্রিকা পড়া, বই পড়া, সাধারণ জ্ঞান বৃদ্ধি করা, সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা এসবই বিসিএস প্রস্তুতির অংশ।

প্রস্তুতি ছাড়া কোন পরীক্ষায় সফল হওয়া যায় না। বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি শুরু করতে যত কম সময় নিবেন, ততই মঙ্গল হবে।

 

৭. ভাইভা বোর্ডেই ক্যাডার নির্ধারণ করা হয়

অনেকে ভাবেন, "ভাইভা বোর্ডে তো ভালো ক্যাডার দেওয়ার সুযোগ থাকে, কারণ সেখানে একাডেমিক রেজাল্ট এবং অন্যান্য দিক দেখেই তো ক্যাডার নির্ধারণ করা হয়!" কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা।

বিসিএস পরীক্ষায় প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে যারা লিখিত পরীক্ষায় (৯০০ নম্বরের মধ্যে) ন্যূনতম ৫০% নম্বর পেয়ে পাস করেছেন, শুধু তারাই ভাইভা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন।

ভাইভা পরীক্ষা ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা, যেখানে ১০০ নম্বর পেলেই আপনি পাস করবেন। ভাইভা ও লিখিত পরীক্ষার ফল একত্রিত করে মেধাক্রমের ভিত্তিতে ক্যাডার নির্ধারণ করা হয়।

যারা উভয় পরীক্ষায় পাস করেছেন কিন্তু ক্যাডার পান না, তাদের থেকে মেধাক্রম অনুসারে প্রথম/দ্বিতীয় শ্রেণির নন-ক্যাডার গেজেটেড পদে সুপারিশ করা হয়।

সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে ভাইভা বোর্ডের হাতে ক্যাডার নির্ধারণের কোন ক্ষমতা নেই।

 

৮. বিসিএস ক্যাডার হওয়ার ক্ষেত্রে সহশিক্ষা কার্যক্রমের কোনো প্রয়োজন নেই

সহশিক্ষা কার্যক্রমের (Extra-curricular activities) ভূমিকা বিসিএস প্রস্তুতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভাইভা পরীক্ষায় আপনাকে আপনার আত্মবিশ্বাস এবং যোগাযোগ দক্ষতা প্রদর্শন করতে হবে।

যারা বিতর্ক (Debate), গান, নাটক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের সামনে আসা এবং নিজের মতামত উপস্থাপন করা সহজ হয়।

এছাড়া, এসব কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করলে একজন প্রার্থী নিজের নেতৃত্বগুণ, পরিস্থিতি মোকাবিলা ক্ষমতা, এবং দক্ষতা সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা পেতে পারেন যা বিসিএসের ভাইভা পরীক্ষায় সহায়ক।

 

৯. বিসিএসের রেজাল্ট প্রকাশ হওয়ার পরপরই সবাই চাকরিতে যোগদান করে

একটি বড় ভুল ধারণা হলো, বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্টের পরপরই ক্যাডাররা চাকরিতে যোগদান করে। কিন্তু বাস্তবে বিসিএস ক্যাডারের নিয়োগ প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ।

বিসিএসের ফল প্রকাশের পর সরকারী সংস্থাগুলি তথ্য যাচাই করে, স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী যাচাই করা হয়, এবং তারপর গেজেট প্রকাশে সময় নেয়।

এক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাডারের চাকরির যোগদানের সময় বিভিন্ন হতে পারে এবং গেজেট প্রকাশ হতে কিছু সময় লাগতে পারে। যেমন- ৩৬তম বিসিএসের রেজাল্টের প্রায় সাড়ে ৯ মাস পরে গেজেট প্রকাশ করা হয়।

এই পুরো প্রক্রিয়াটি অনেক ধীর গতির এবং অনেক সময় নেয়, যা অনেকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে।


১০. বিসিএস ক্যাডার হওয়ার উদ্দেশ্যই হলো ঘুষ খাওয়া এবং বড়লোক হওয়া

এটি একদম ভুল ধারণা। যারা এ ধরনের ধারণা পোষণ করেন, তারা হয়তো বিসিএসের প্রকৃতি বুঝেন না। বিসিএস ক্যাডার হতে হলে একটি নীতিবদ্ধ, পরিশ্রমী, এবং সৎ পথে চলতে হয়।

আপনার লক্ষ্য যদি সৎ থাকে এবং আপনি ভালোভাবে প্রস্তুতি নেন, তবে আপনি বিসিএস ক্যাডার হতে পারবেন।

তবে এই পরীক্ষার মাধ্যমেই আপনি দেশের সেবায় অংশ নিতে পারেন, এবং সরকারী চাকরি যেমন, চাকরির নিরাপত্তা, বেতন, সুযোগ-সুবিধা সব কিছু থাকবে।

 

শেষ কথা

বিসিএস নিয়ে বিভিন্ন ভুল ধারণা থাকলেও সঠিক তথ্য এবং সচেতনতার মাধ্যমে এগুলো দূর করা সম্ভব। সফলতার জন্য প্রয়োজন সঠিক গাইডলাইন, প্রস্তুতি, পরিশ্রম, এবং আত্মবিশ্বাস।

বিসিএস ক্যাডার হওয়া শুধু ব্যক্তিগত অর্জনের বিষয় নয়, এটি দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার একটি সুযোগ।

আপনার যদি লক্ষ্য থাকে সৎ এবং নিষ্ঠার সাথে নিজের স্বপ্ন পূরণ করার, তবে ভুল ধারণাগুলোর পেছনে না ছুটে নিজের মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগান।

মনে রাখুন, সাফল্যের পথে কোনো শর্টকাট নেই, আর সঠিক প্রচেষ্টাই আপনাকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।

Leave A Reply

Already have an account ? Sign in to leave a reply

Comments

Top Categories

BCS

10

Primary

4

NTRCA

3

Digital Marketing

4

Graphic design

2

Technology

1

More Blogs

Primary

২০২৫-এ প্রাইমারি শিক্ষক পেশায় সুযোগ-সুবিধা এবং অসুবিধা বিশ্লেষণ

Humyara Yeasmin |

25 February 2025

Primary

২০২৫ সালের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতির ৬ টি কার্যকরী গাইডলাইন!

Humyara Yeasmin |

17 February 2025

Technology

সাইবার সিকিউরিটি (Cyber Security) কি? কেন এটা জরুরি? শিখতে কি কি লাগে? বিস্তারিত আলোচনা

Sohel Rana Srabon |

22 December 2024

ডাউনলোড করুন

বিদ্যাবাড়ি App

180K+

Learners

4.7

Positive
Reviews

180+

Skill based Courses

ডাউনলোড করুন বিদ্যাবাড়ি অ্যাপ,
শুরু করুন এখান থেকেই

অভিযোগ বক্স