আপডেট:
10 April 2025
নিষিদ্ধ নজরুল : ‘আনন্দময়ীর আগমনে’

নিষিদ্ধ
নজরুল : ‘আনন্দময়ীর
আগমনে’
দেবশিশুদের
মারছে চাবুক, বীর যুবাদের
দিচ্ছে ফাঁসি
ভূ-ভারত আজ
কসাইখানা, আসবি কখন
সর্বনাশী!
কি
বুঝলেন লাইন ২টি পড়ে? আমি যতোবারই
বিদ্রোহী কবির ‘আনন্দময়ীর
আগমনে’ কবিতাটি পড়েছি ততোবারই মনে হয়েছে ,
এ যেন কোন উত্তাল ঝড়ের ডাক। কবিতাটি স্থান
পেয়েছিলো কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ দোলনচাঁপা-য়। বিদ্রোহী কবির এই কবিতার
শব্দমালায় এতোই জোর ছিলো যে,অত্যাচারী
শাসকেরও রুহে ভয়ের কাঁপন ধরে গিয়েছিলো। যার প্রমাণ স্বরূপ, নিষেধাজ্ঞার তকমা নিয়ে বাজেয়াপ্ত হতে হয়েছিলো কবিতাটিকে।
মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের জেলখানার শিকগুলো সাক্ষী নজরুলের সেই কারাবরণের
গৌরবান্বিত দিনগুলোর।
বাঙ্গালির
জীবনে ধর্মীয় উৎসব কেবল কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না। আর এটাই
বাঙ্গালির হাজার বছরের সংস্কৃতি। কিন্তু ঐ বছরটা? ১৯২২-এর সেই শারদীয়া? বিধাতার
মর্জিই যেন ছিলো কিছু ভিন্ন। চারদিকে শারদীয় সাজ সাজ রব, প্রশান্তির বাতাস। এর মাঝেই ছন্দপতন! হঠাৎ করেই যেন শান্তিপ্রিয়
বাঙ্গালি জাতির জীবনে ঝড় উঠলো। সব কিছু কেমন করে যেন উলটপালট হয়ে গেল।
পূজা
শুরু হওয়ার আগেই অশান্তির আগমন, লণ্ডভণ্ড
হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর। ক্ষোভ জমলো সাধারণ জনতার মনে। সাম্রাজ্যবাদী
অপশক্তির অপশাসনের কবলে, গোটা
দেশটাই যেন লুটেরাদের দখলে। তবে, এর
মাঝে নজরুল করে বসলেন শোষকের অন্তরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়ার মতো কাণ্ড। জনতার সাথে
জনতার কাতারে দাঁড়ানো নজরুলের প্রতিবাদের ভাষাটা ছিলো সবসময়ের মতোই ভিন্ন তবে,
অসাধারণ।
জনতার
দ্রোহের অনলে যখন পুড়ছে বাংলা, সে
সময়ে কবি বিদ্রোহ ঢেলে দিলেন তাঁর শব্দে। লিখে ফেললেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা।
ছন্দের জাদুতে প্রকাশ ঘটালেন নিজের ভাবাবেগের। আর এতেই যেন ভারতবর্ষের আপামর জনতার
বিবেকের জগতে ভূমিকম্প হলো। এক কবিতাই যেন বলে দিলো, কোটি মানুষের কথা। কাঁপন ধরালো সাম্রাজ্যবাদের খুঁটিতে। পাঠিয়ে দিলেন
কবিকে কারাগারে। কী ছিলো কবির সেই শব্দমালায়?
২৬
সেপ্টেম্বর, ১৯২২।
প্রথমবারের মতো আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয় স্বয়ং কবি সম্পাদিত ধূমকেতু
পত্রিকাতেই। ধূমকেতু, তখন কোন সাধারণ
পত্রিকা নয়। এ যেন তার নামের মতোই পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে ফুড়ে ছুটে চলা এক
মহাজাগতিক বস্তু। বিপ্লবীদের অগ্নিবাণী প্রচারের এক বিশ্বস্ত প্রচারমাধ্যম।
‘ধূমকেতু’
ছিলো না কখনোই শাসকের সুনজরে। কিন্তু আনন্দময়ীর
আগমনে এবার যেন তাদের রোষানলের ষোলকলাই পূর্ণ করলো। নভেম্বরের ৮ তারিখ ‘ধূমকেতুর’ অফিসে হলো পুলিশের আগমন। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বাজেয়াপ্ত করলো ২৬
সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘ধূমকেতু’র সকল সংখ্যা। কবিও হয়তো সেদিন ধরা পড়তেন যদি না
তিনি কলকাতার বাইরে থাকতেন। তবে ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটেই গেলো ২৩ নভেম্বর, ১৯২২ সালে। এদিন কবি কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে তাঁকে ১ বছরের সশ্রম
কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
শেষে এসে বলবো,
নজরুলের
‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি শুধু একটি কবিতা নয়, এর
শব্দমালা সরাসরি শোষকের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলে, ‘তুমি জুলুম, তো আমি
দ্রোহ’। আমি ভাবি, নজরুলের কলমে যে আগুন ছিল তা কি আজও আমাদের মনে জ্বলে?
শাসকপক্ষ
নজরুলের দেহকে তো কারাগারের শিকের আড়ালে বন্দী করতে পেরেছিলো কিন্তু তাঁর মেধাকে
কখনো আটকে রাখতে পারেনি। তাঁর শব্দে নিহীত বার্তা পৌঁছেই গিয়েছিলো মজলুম জনতার
কাছে। জ্বেলে দিয়েছিলো দ্রোহের দামামা, অত্যাচারীর
অপশাসনের বিরুদ্ধে। নজরুল আমাদের শিক্ষা দেয়, সত্যের পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠস্বরকে দমানো অসম্ভব,অবাস্তব। নজরুলের কবিতা আমাদের মাঝে আজও ধূমকেতুর মতো দ্রোহের
প্রজ্জলিকা জ্বালে।
তাই
চলুন, আমরাও নজরুলের মতো সাহসী হয়ে
পৃথিবীময় চলমান সকল অনাচার, অবিচারের
বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে রুখে দেই অমানবিক সকল আগ্রাসন।